ডিজিটাল প্রযুক্তির অগ্রযাত্রায় মোবাইল-ভিত্তিক অ্যাপ ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মের সহজলভ্যতা বেড়েছে। তবে এর নেতিবাচক দিকও স্পষ্ট হয়ে উঠছে, বিশেষ করে অনলাইন জুয়া ও আসক্তিমূলক গেমসের মাধ্যমে যুবসমাজ ও কিশোরদের নিঃস্ব হওয়ার প্রবণতা। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে এই নতুন ধরণের আসক্তি। এতে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি সমাজে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে।
অনলাইন জুয়ার বিস্তার ও কিশোরদের আসক্তির কারণঃ
সহজলভ্যতা ও আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন- সোশ্যাল মিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইটে অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপন সহজেই মানুষের নজরে আসে। মোবাইল গেমের মধ্যেও নানা ধরনের ইন-অ্যাপ পারচেজের মাধ্যমে কিশোরদের আকৃষ্ট করা হয়।
প্রলোভন ও লোভ– বড় অঙ্কের অর্থ জয়ের মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে তরুণদের ফাঁদে ফেলা হয়। অনেকেই দ্রুত ধনী হওয়ার স্বপ্নে এই জুয়ার জালে আটকে পড়েন।
সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব– বিভিন্ন সেলিব্রিটি ও সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের মাধ্যমে এসব গেম ও জুয়ার প্রচার করা হয়, যা তরুণদের মধ্যে সহজেই জনপ্রিয়তা পায়।
বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক সংকট– কাজের অভাবে অনেক যুবক সহজ উপায়ে অর্থ উপার্জনের আশায় জুয়ায় জড়াচ্ছে, যা তাদের আর্থিকভাবে আরও দুর্বল করে দিচ্ছে।
পরিবারের নজরদারির অভাব- ব্যস্ত জীবনযাত্রার কারণে অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের ডিজিটাল কার্যক্রমের দিকে নজর দিতে পারছেন না, ফলে তারা সহজেই এই আসক্তিতে জড়িয়ে পড়ছে।
এ আসক্তির পরিণতি ও ঝুঁকিঃ- আর্থিক ক্ষতি: অনেকেই সর্বস্ব হারিয়ে দেন এবং ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়ে পড়েন।
মানসিক সমস্যা: হতাশা, উদ্বেগ, রাগ নিয়ন্ত্রণের অভাবসহ নানা মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হয়।
পারিবারিক কলহ: আর্থিক ক্ষতি ও মানসিক অস্থিরতার কারণে পারিবারিক অশান্তি বাড়ে।
অপরাধ প্রবণতা: টাকা জোগাড় করতে গিয়ে অনেকেই চুরি, ছিনতাই বা মাদক ব্যবসার মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
সমাধান ও প্রতিরোধে করণীয়ঃ- *পরিবারের ভূমিকা, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শ: সন্তানরা অনলাইনে কী করছে, কোন অ্যাপ ব্যবহার করছে, সে বিষয়ে সচেতন থাকা জরুরি। তাদের মানসিক ও আর্থিক অবস্থার প্রতি খেয়াল রাখা দরকার।
বিকল্প বিনোদন ব্যবস্থা: সন্তানদের খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ও অন্যান্য গঠনমূলক কাজে উৎসাহিত করা প্রয়োজন।
ডিজিটাল লিমিট সেট করা: মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় নির্ধারণ করা এবং গেমিং ও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি নির্ভরতা কমানো।
*সমাজের ভূমিকাঃ- সচেতনতা বৃদ্ধি: স্কুল-কলেজে অনলাইন জুয়া ও গেম আসক্তির ক্ষতিকর দিক নিয়ে আলোচনা করা উচিত। স্থানীয় সংগঠনগুলোর মাধ্যমে জনসচেতনতামূলক প্রচার চালানো দরকার।
যুব উন্নয়ন কর্মসূচি: তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো দরকার, যাতে তারা অনলাইন জুয়া থেকে দূরে থাকে। ফ্রিল্যান্সিং, প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ, উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রোগ্রাম চালু করা যেতে পারে।
*রাষ্ট্রের ভূমিকাঃ
কঠোর আইনি ব্যবস্থা: দেশে অনলাইন জুয়া পরিচালনাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। বেআইনি গেমিং অ্যাপ ও ওয়েবসাইট ব্লক করার জন্য প্রযুক্তিগত নজরদারি বাড়াতে হবে।
নিয়ন্ত্রিত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম: অ্যাপ স্টোর ও গুগল প্লে-তে অনলাইন জুয়া সম্পর্কিত অ্যাপ নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোকে এসব বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ করতে বাধ্য করতে হবে।
সাইবার নিরাপত্তা জোরদার: বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (BTRC)-এর মাধ্যমে অনলাইন জুয়ার ওয়েবসাইট ও অ্যাপস নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। ভুয়া লোভনীয় বিজ্ঞাপন প্রচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
অনলাইন জুয়া ও গেমসের আসক্তি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। সচেতনতা ও কার্যকর আইনি পদক্ষেপের মাধ্যমে এই আসক্তির লাগাম টেনে ধরা গেলে যুবসমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
লেখকঃ গণমাধ্যম, মানবাধিকার ও সামাজিক কর্মী