সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা নিয়ে দেশের দুই প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল ব্লেইম গেম খেলছে যেখানে সংখ্যালঘুরা আছে অস্ত্বিত্বের সঙ্কটে- বলে মন্তব্য করেছেন দৈনিক ভোরের কাগজ পত্রিকার সম্পাদক শ্যামল দত্ত। যমুনা টেলিভিশনের টক শো ‘আমজনতা’য় এমন মন্তব্য করেন তিনি।
উপস্থাপকের প্রশ্নের উত্তরে শ্যামল দত্ত বলেন, দেখুন আমরা একটা কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে আছি। এখানে কারো সমস্যা নির্বাচন কেন হচ্ছে না, আবার কারো সমস্যা বিরোধী দলকে ঘায়েল করা। এরমধ্যে আমার সমস্যাটা হচ্ছে ‘অস্তিত্বের সঙ্কট’। এদেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী কতটা নিরাপত্তা ঝুঁকিতে আছে তা আপনি পীরগঞ্জের হরিদাস রায়ের ইন্টারভিউ দেখলেই বুঝবেন। হরিদাশ স্ত্রী-সন্তানের মুখ চেপে ধরে সারারাত ধানক্ষেতে লুকিয়ে ছিলেন। এরকম পরিস্থিতি সর্বশেষ হয়েছিলো মুক্তিযুদ্ধের সময়। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও কেন একজন সংখ্যালঘু নাগরিককে এরকম পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে সে সঙ্কট নিয়ে আমরা কেউ আলোচনা করছি না।
দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের পারস্পরিক কাদা ছোঁড়াছুড়ি নিয়ে শ্যামল দত্ত বলেন, দুই রাজনৈতিক দলই ব্লেইম গেম খেলছে, কিন্তু সংখ্যালঘুরা বারবার কেন একই সঙ্কটে পড়ছে তা নিয়ে কেউ আলোচনা করছে না। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার এ আগুনে বাংলাদেশ পুড়ছে, মুক্তিযুদ্ধ পুড়ছে। যে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে দেশের জন্ম, সে দেশ কি সেই জায়গায় আছে এখন?
সংখ্যালঘু নির্যাতনে বিদ্যমান বিচারহীনতা নিয়ে শ্যামল দত্তের মন্তব্য, একটা ঘটনারও যদি বিচার না হয় তাহলে বারবার এসব ঘটনা ঘটতেই থাকবে। ২০০১ এ নির্বাচনের আগে ও পরে দেশে প্রায় ২৭ হাজার সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। পরবর্তী সময়ে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিরুদ্ধে সাড়ে ৩ হাজার মামলার সুপারিশ করেছিলো। অথচ তারা এখন আমাদেরকে বলছে যে, সেসব মামলার বিচারকাজ শুরুই হয়নি! ২১ বছরেও যে অন্যায়ের বিচার হয় না, সেখানে আপনি আর কিসের বিচার চান? রামু, নাসিরনগর, লামা, বান্দরবান বা শাল্লায় ঘটা ঘটনার কোনো বিচার হয়নি। এরকম একাধিক ঘটনার যখন বিচারই হয় না তখন আপনি এসব বন্ধ করবেন কী দিয়ে? এবার দেখা গেছে যে, পূজা মণ্ডপগুলোয় কোনো নিরাপত্তা নেই, আর রাজনৈতিক শক্তিই বা কোথায়! অসাম্প্রদায়িক আচরণ ও ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনীতির কথা বলায় আওয়ামী লীগের ওপর মানুষের ভরসা থাকে একটু বেশি, কিন্তু অষ্টমী থেকে আজ পর্যন্ত গত ৫ দিনে আওয়ামী লীগের কোনো ভূমিকা দেখিনি। অথচ ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার প্রতিবাদে হওয়া প্রথম মিছিলের নেতৃত্বে দিয়েছেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজকের আওয়ামী লীগ কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে যে, তারা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সেই জোরালো অবস্থানে এখনও আছে বা সেই অবস্থান তারা আর নিতে পারবে কি? পারবে না, আমরা দেশের কোথাও আওয়ামী লীগ নেতাদের নামতে দেখিনি।
উদাহরণ দিয়ে শ্যামল দত্ত বলেন, গত পরশু ফেনীতে হওয়া ঘটনার পর সেখানকার আওয়ামী লীগ নেতাদের দেখা যায়নি, সেখানকার স্থানীয় এমপি তো আওয়ামী লীগেরই, তাকেও কোনো প্রতিবাদে নামতে দেখা যায়নি। এমনকি, একের পর এক হিন্দুদের দোকান পোড়ানোর সময় কোনো আওয়ামী লীগ নেতাকে প্রতিবাদে নামতে দেখা যায়নি।
নিরাপত্তাহীনতার কারণে দেশে একটা বিশেষ ধর্মের নাগরিকের সংখ্যা কমে যাওয়া নিয়ে উপস্থাপক শ্যামল দত্তের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১৯৪৭ এ দেশভাগের পর এদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ২৯ শতাংশ থেকে কমে ৯ শতাংশে কেন আসলো তার পরিসংখ্যান আপনাদেরকে অবশ্যই নিতে হবে। দেখুন, অষ্টমীর রাতে আমি নিজে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি। আমি গ্রামে ছিলাম, সেখানকার বহু মানুষ আমাকে বলেছে, যে এদেশে বুঝি আর থাকা হবে না। এরকম নিরাপত্তাহীনতা, অসহায়ত্ব ও বিচারহীনতার কারণেই তাদের সংখ্যা কমেছে। ১৯৭১ এ বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি, গত পঞ্চাশ বছরে জনসংখ্যা বেড়ে ১৭ বা ১৮ কোটি হয়েছে। কিন্তু দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যা কেন ২৯% থেকে কমে ৯% এ নেমে আসলো, এর কারণ কি আমরা কোনোদিনও অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছি? বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেভাবে ধর্মের ব্যবহার হয়েছে বা ৭৫ পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যেভাবে সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে আপোষ করেছে, সেই আপোষের রাজনীতির কারণেই মানুষ এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। শাল্লার ঘটনায় গ্রেফতার ঝুমন দাসকে জেলে রাখার কারণ ব্যাখ্যা করে পুলিশ বলেছে যে, বাইরে তার নিরাপত্তা দিতে পারছে না বলেই ঝুমনকে জেলে রাখা হয়েছে। আমার প্রশ্ন হলো, আপনি নিরাপত্তা দিতে না পেরে কতজনকে এভাবে জেলে রাখবেন বা রাখতে পারবেন?
সংখ্যালঘুদের জন্য একটা ভারসাম্যপূর্ণ সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা কে নিশ্চিত করবে, উপস্থাপকের এমন প্রশ্নের জবাবে সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, এখন আমি কি নৈতিক ভাবনা ভাববো নাকি আমার বাস্তবতা নিয়ে ভাববো? দেশের মধ্যে আমার নিরাপত্তা যদি আপনি নিশ্চিত করতে না পারেন তাহলে নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী আছে কেন? হামলাকারীরা কি নিরাপত্তা বাহিনীকে জানিয়ে হামলা চালাবে? দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমার কি নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার নেই? দেশে ঘটা যেকোনো কিছুর ভিকটিম কেন শুধু সংখ্যালঘুকেই হতে হবে? আমার মন্দির-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব কার? পীরগঞ্জের গরীব মানুষগুলোর কথা ভাবুন একবার, তারা একরাতের মধ্যে নিঃস্ব হয়ে গেছে। ফেনীর ঘটনার সময় পুলিশের কাছে সাহায্য চেয়েছে, পুলিশ আসেনি। বিজিবি এর কাছে সাহায্য চেয়েছে, বিজিবি বলেছে- ডিসি’র অর্ডার ছাড়া যাওয়া যাবে না। র্যাবের কাছে সাহায্য চেয়েও র্যাব যায়নি। এরমধ্যেই মন্দির-বাড়িঘর-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়েছে। এখন মানুষ যাবে কোথায়? মানুষের অসহায়ত্ব এতটাই চরম যে, এখন এই রাজনৈতিক বাদানুবাদের আসলে কোনো গুরুত্ব নেই। এখন আমার অস্ত্বিত্বের সঙ্কট আর তাদের চিন্তা ক্ষমতায় কে যাবে বা যাবে না। আমার এমন সঙ্কটে আমি রাজনৈতিক বাহাস করতে পারছি না।