দেশের সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক বাজেট। এখানে সরকারের আগামী বছরের অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, উন্নয়ন কৌশল এবং অন্যান্য প্রকল্প সম্পর্কে নজর রাখতে হবে । এর সঙ্গে সরকারের রাজস্ব আদায়, রাজস্ব ব্যয় এবং অন্যান্য ব্যয় সম্পর্ক জড়িত । একটি সরকারের বাজেটের সঙ্গে বেসরকারি সংস্থা বা যেকোনো সংস্থার বাজেটের ভিন্নতা আছে।
কারণ সরকারি বাজেটটি সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাব হলেও সেটি কিন্তু তিনটি পক্ষকে প্রভাবিত করে। একটি হলো সরকারের আয়-ব্যয়, দ্বিতীয়টি হলো বেসরকারি খাত—বেসরকারি খাতের সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং তৃতীয়টি হলো জনগণের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।
বাজেট কল্যাণমুখী হতে হবে আমি কয়েকটি জিনিসের ওপর দৃষ্টিপাত করব। প্রথমত বাজেটের যে আকার, সেটি নিয়ে অনেক কথা বলা হয়ে থাকে। কেউ বলে যে বড় হয়েছে, আরেকটু ছোট করা উচিত ছিল।
আমার মতে, আগামী বাজেট বড় হলে ক্ষতি নেই। কারণ বাংলাদেশের উন্নয়নে সরকারের যে ভূমিকা সেটি অনেক বড়। সে হিসেবে বাজেট কিছুটা বড় হতে পারে। বড় হওয়া মানে এই নয় যে অর্থের অপচয় হবে বা অর্থ ঠিকমতো ব্যবহার করা হবে না। মোটকথা হচ্ছে, বাজেটের আকার যা-ই থাকুক, সেটি সঠিকভাবে ব্যয় হবে। এর সুফল ব্যবসা-বাণিজ্যে এবং জনগণের কাছে পৌঁছাবে।
বাজেটের ব্যাপারে দুটি জিনিস মনে রাখা দরকার। সরকার যে টাকা খরচ করবে, এটি আহরণ কিভাবে করবে। সম্পদ কিভাবে আহরণ করবে। ট্যাক্সের মাধ্যমে, অন্যান্য ফির মাধ্যমে বা ঋণের মাধ্যমে করবে কি না, সেটি দেখার বিষয়। আরেকটি বিষয় হলো বণ্টন। কোন খাতে কী রকম বণ্টন করবে। কত টাকা কোন খাতে দেবে। প্রশাসনে কত ব্যয় করবে। চিকিত্সা খাতে কত টাকা ব্যয় করবে। শিক্ষায় কত টাকা ব্যয় করবে।
এখন আসা যাক সম্পদ আহরণ বিষয়ে। বাংলাদেশে কর হলো সরকারের সবচেয়ে বড় একটি অর্থের উৎস। সেই করটি আমাদের দেশে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আদায় করে। সেই করের মূল উৎসটিই হলো মূল্য সংযোজন কর অর্থাৎ পরোক্ষ কর। পৃথিবীর সব দেশেই কিন্তু মূল্য সংযোজন করের চেয়ে বেশি হচ্ছে প্রত্যক্ষ কর। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার হলো প্রত্যক্ষ কর; যেমন—আয়কর। পরোক্ষ করে অসুবিধা হচ্ছে ভ্যাটটি ধনী-গরিব সবাইকে সমহারে দিতে হয়। যেমন—আটার ওপরে একটি ভ্যাট দেওয়া হয়েছে। এটি বড়লোকদের যে পরিমাণ ট্যাক্স দিতে হয়, দরিদ্রও সে রকম ট্যাক্স দেয়। এটি ঠিক ইকিউটি বা সমতার মানদণ্ডে যুক্তিসংগত নয়।
ট্যাক্স জিডিপি কিন্তু বাংলাদেশে অত্যন্ত কম। এটি ৮ বা ৯ শতাংশের মতো, যেটি পৃথিবীর সবচেয়ে কম রেশিও। নেপালের মতো একটি দেশে ১৪ শতাংশ। ভারতে প্রায় ১৫-১৬ শতাংশ। আর উত্তর ইউরোপে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ট্যাক্স জিডিপি রেশিও। সেখানে কিন্তু সরকারের ব্যয়গুলো কল্যাণমুখী ও জনগণের সুবিধার্থে হয়ে থাকে।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়। আমাদের এনবিআরের এখনো তেমন সংস্কার হয়নি। ডিজিটাইজেশন হয়নি। এনবিআর যেটি করে তার কর্মকর্তার মাধ্যমে ট্যাক্স আদায় করে। এখানে কিন্তু এই কর্মকর্তা ও ট্যাক্সের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ হয়। এটি কিন্তু কোনোক্রমেই কাম্য নয়। উন্নত দেশে জনগণ ট্যাক্স পে করে ই-মেইলের মাধ্যমে, কাগজপত্রের মাধ্যমে। সামনাসামনি যোগাযোগ হলেই কিন্তু নানা রকম নেগোসিয়েশন, নানা রকম আদান-প্রদান হয়ে থাকে।
যে ট্যাক্স দেবে তার ব্যক্তিগত পরিচয়, তার সম্পর্কে একটু জানাশোনা। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ট্যাক্স আদায়ে আধুনিক হতে হবে।
তৃতীয় নম্বর একটি হলো যে আমাদের দেশে এখনো ট্যাক্সের নেট বা জালটি ছোট। বিশেষ করে প্রত্যক্ষ ট্যাক্স প্রদানকারীর সংখ্যা অনেক কম। এমনকি টিআইএন আছে বহু লোকের, তারা অনেকে ট্যাক্স দেয় না। বারবার বলা হচ্ছে ট্যাক্সের হার না বাড়িয়ে ট্যাক্সের নেটটি বাড়ান। ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে ট্যাক্স দেয় অতি নগণ্য সংখ্যক কিছু লোক। এখানে বহু ব্যবসায়ী আছেন, বহু চাকরিজীবী আছেন, বহু সম্পদশালী লোক আছেন, ট্যাক্স দেন না বা তাঁদের অনেকের টিআইএন নেই। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, বেশির ভাগ ট্যাক্স প্রদানকারী শহর অঞ্চলের । বিভিন্ন জায়গায় এখন অনেক দোকান মালিক আছেন, গ্রামে-গঞ্জে এখন অনেক ভালো দোকান আছে, তারা ট্যাক্সের আওতায় নেই। ট্যাক্স দেয়ই না। পৃথিবীর কোনো দেশে কিন্তু এত সংখ্যক মানুষ ট্যাক্সের বাইরে নেই। তাই জরিপ করে বের করতে হবে কারা কারা আয়কর দেওয়ার যোগ্য।
আরেকটি জিনিস হলো আমাদের লোকাল গভর্নমেন্ট অর্থাৎ স্থানীয় সরকার। এখানে ইউনিয়ন পরিষদ আছে, উপজেলা পরিষদ আছে। সেখানে যে ট্যাক্স সংগ্রহ করা হয়, তা অত্যন্ত সীমিত। সেখানে সীমাবদ্ধতা আছে। তবু তাদের ট্যাক্স আদায় আরো বৃদ্ধি করা উচিত। ওখানে ট্যাক্স বাড়লে, তারা স্থানীয়ভাবে খরচ করতে পারবে। স্থানীয় উন্নয়ন কাজ করতে পারবে। তবে যদি শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের ট্যাক্সের ওপর নির্ভর করে, তাহলে সরকার যে যত্সামান্য বরাদ্দ দেয় স্থানীয় সরকারকে, তা দিয়ে স্থানীয় সরকারের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করা সম্ভব হয় না। আমাদের স্থানীয় সম্পদ আহরণ আরো বৃদ্ধি করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে সম্পদ আহরণ ইউনিয়ন পরিষদ করবে, জেলা পরিষদ করবে, উপজেলা পরিষদ করবে।
আমরা দেখি, এডিবি—বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা একটি বিরাট হয়ে থাকে। এটিতে অনেক প্রজেক্ট থাকে। আমার পরামর্শ হলো এডিবি একদম কাটছাঁট করে ফেলা। গুটিকয়েক অত্যন্ত জরুরি ভৌত অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য—এই কয়েকটি বিশেষ সেক্টরে এডিবি উন্নয়ন প্রকল্প থাকবে। অন্য কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য নেওয়া যাবে না। কারণ এখন আমাদের অর্থের সংস্থান করার অনেক চ্যালেঞ্জ আছে।
সরকারের আয়ের ক্ষেত্রে যা করা দরকার তা হচ্ছে—১. করযোগ্য সবার কাছ থেকে প্রত্যক্ষ কর আদায়ের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা; ২. প্রাইভেট গাড়ির ওপর বাৎসরিক করের পরিমাণ বাড়িয়ে কমপক্ষে ৫০ হাজার করা; ৩. সরকারের প্রতিটি বিভাগকে আয়ের একটি নির্দিষ্ট টার্গেট দেওয়া; ৪. স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ আয়ের টার্গেট দেওয়া; ৫. স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান গুলোকে নিজস্ব আয়ে উদ্বুদ্ধ করা এবং তার সঙ্গে বার্ষিক বরাদ্দের একটি সম্পর্ক তৈরি করা; ৬. বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নিয়মিত সরকারি পাওনা টাকা আদায় করা; ৭. সম্পদ কর চালু করা; ৮. চিকিৎসক, উকিলসহ বিভিন্ন পেশাদার গ্রুপ থেকে অনলাইনে মাসিক কর আদায় করা; ৯. বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে তা থেকে আয় বাড়ানো।
কল্যাণ খাতে যা করা দরকার তা হচ্ছে—১. গরিবদের জন্য বিভিন্ন ভাতার পরিমাণ বাড়ানো এবং তাদের জন্য রেশনের ব্যবস্থা করা; ২. আটটি বিভাগে অন্তত আটটি মানসিক হাসপাতাল স্থাপন করা এবং রাস্তায় ভ্রাম্যমাণ মানসিক রোগীদের রাষ্ট্রীয় খরচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা; ৩. রাস্তায় পড়ে থাকা অনাথদের সরকারি-বেসরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে পুনর্বাসন করা; ৪. ওষুধের মূল্য যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা; ৫. শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়িয়ে উন্নয়ন ও উৎপাদনে অবদান রাখা; ৬. বয়স্ক নাগরিকদের কম মূল্যে ওষুধ ও রেশন দিয়ে বয়স্ক দারিদ্র্য কমিয়ে আনা; ৭. পিপিপি ব্যাপকভাবে চালু করে সরকারি ব্যয় কমানো; ১৪. আয়বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্য বাজেটে ব্যয়ের ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া; এবং ৮. দেশের সব প্রবীণকে পেনশনের আওতায় নিয়ে আসা।
লেখক
সালাউদ্দিন মোল্লা
সহকারী পরিচালক (অর্থ)
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।