সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি সংক্রান্ত এলোমলো কিছু ভাবনা মাথায় চেপে বসেছে। নীতিনির্ধারণী মহলের সার্বিক চিন্তার ফসল হয়তোবা এই মূল্যবৃদ্ধি যা আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছে। তারপরও অতি সাধারণ নাগরিক হিসেবে এতদসংক্রান্তে কিছু জিজ্ঞাসা আমাকেই তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণের জন্য কোন সুনির্দিষ্ট মেথড রয়েছে কিনা জানা নেই। ক্ষুদ্র জ্ঞানে যতদূর জানি আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেলেই তার সমন্বয়ের জন্য নীতি নির্ধারণী মহল কর্তৃক দেশে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। বিপরীতে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানী তেলের মূল্য কমে গেলে সে অনুপাতে দেশের আভ্যন্তরীণ বাজারে তেলের মূল্য কমাতে খুবই কমই শুনেছি। জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাসবৃদ্ধি সংক্রান্তে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা যদি না থাকে তাহলে প্রতিবার মূল্যবৃদ্ধিই হবে সাধারনের নিকট প্রশ্নবিদ্ধ।
সা¤প্রতিক সময়ে জ্বালানী তেলের মুল্য বৃদ্ধি সংক্রান্তে এবং নীতিনির্ধারণী মহল কর্তৃক অতি দ্রæত সময়ের মধ্যেই বাস্তাবায়ন জনসাধারণের মনে রক্তক্ষরণ করিয়েছে অনেক। সরকার বিভিন্ন ধরনের ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক এবং এটার প্রয়োজন ও যৌক্তিকতাও রয়েছে। ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসার পরিকল্পনা কার্যকর করতে হবে খুবই সুপরিকল্পিতভাবে যাতে সাধারন জনগনের খুব বেশী কষ্ট না হয়। কোভিড মহামারিতে পুরো বিশ্ব যেখানে হিমশিম খাচ্ছে সেখানে আমাদের দেশের কি অবস্থা তা বলে কেউ শেষ করা যাবে বলে মনে হয় না। কোভিড পরবর্তী দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল করার জন্য যখন পুরোবিশ্বের মত বাংলাদেশের জনগণও উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে ঠিক সেই মুহূর্তে এই মূল্যবৃদ্ধি অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য দেশ ও দশ এর ঘুরে দাঁড়াতে কতটুকু পজেটিভ ভ‚মিকা রাখলো? মনে হলো ঘুরে দাঁড়ানোর পথটা রুদ্ধ হল।
আন্তর্জাতিক বাজারে যখন জ্বালানী তেলের মূল্য একেবারে নেমে গিয়েছিল তখন কোভিড মহামারিতেও আমাদের জ্বালানী তেলের উচ্চমূল্য পরিশোধ করতে হয়েছিল।সে সময়ে অতিরিক্ত মূল্য হিসেবে আমাদের পরিশোধিত সেই অর্থ তো এখনকার ঘাটতি পূরণ হওয়ার কথা। বিভিন্ন পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে জ্বালানী তেল বাজারজাতকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন এর (বিপিসি) ২০০৮ – ২০১৪ অর্থবছরে সর্বমোট লোকসান ছিল প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকার। পরবর্তীতে ২০১৫ থেকে ২০২১ অর্থবছরে লাভ করেছে ৪৩ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। এতে প্রতীয়মান হয় তেল বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান টি বর্তমানে ইতিবাচক ধারায় রয়েছে।
কোভিড পরিস্থিতিতে দেশের ভংগুর অর্থনীতিকে সচল এবং দেশের সাধারণ মানুষের দুঃখ কষ্টের চিন্তা করে কোভিড পরবর্তী ঠিক এই মুহূর্তে রিলেটেড সবকিছু এলোমেলো রেখে তড়িঘড়ি করে এই মূল্য বৃদ্ধি আপততঃ না করলে পারতেন নীতিনির্ধারণী মহল।
ফলশ্রæতিতে সাধারণ জনসাধারণ উপকৃত হতো। সিপিডি’র হিসেব অনুযায়ী জ্বালানি তেলে ৩৪ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের শুল্ক ও লভ্যাংশ মিলে প্রতি বছর বিপুল পরিমানে অর্থ জমা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। ২০১৯ -২০২০ অর্থবছরে ১৪ হাজার ১২৩ কোটি টাকা। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ৯ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা। এরপরও যদি রাষ্ট্রীয় জ্বালানী তেলে যদি ঘাটতি থাকে তাহলে কোভিড পরিস্থিতির বিবেচনায় নীতিনির্ধারণী মহল কিছু শুল্ক প্রত্যাহার করে সে ঘাটতি কিছু অংশ যদি পুরণ করতে পারতো তাহলে কিছু টা হলেও দেশ ও দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি মিলতো। এটাও যদি সম্ভব না হত তাহলে বিশ্ববাজারে জ্বালানী তেলের বর্তমান এই উচ্চমূল্য যখন কমে যেত তখন দেশে মূল্য না কমিয়ে তা সমন্বয় করে কোভিড পরবর্তী সংকট মোকাবেলা করলে দেশ ও দশ কোন ব্যথাই অনুভব করত না। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মুল্য প্রতিনিয়তই উঠানামা করে এ সুযোগ পূর্বেও মিলেছে আগামীতেও মিলতো। জ্বালানী তেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং পরিবহন সেক্টরের বিভিন্ন রুটে অযৌক্তিক ভাড়া বৃদ্ধি সাধারণের জন্য নিতান্তই অসুখকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। জ্বালানী তেলের মুল্যবৃদ্ধির বিভিন্ন প্রক্রিয়াগত সমন্বয়হীনতার কারণেই এ অসুখকর পরিস্থিতির সৃস্টি হয়েছে বলে মনে হয়। জ্বালানী তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে আবশ্যম্ভাবী অর্থনৈতিক বিপর্যয় মোকাবেলা করতে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ তাদের শ্রম মূল্য ইতোমধ্যেই বৃদ্ধি করে দিয়েছে। শুনেছি রিকশার চেইন-এ তেল দিতে হয় বিধায় রিকশা চালকগণও রিক্সার ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন তা অবশ্য ধর্মঘট নাটক ব্যতিরেকে। এভাবে একে একে সকল শ্রেণী পেশার মানুষ তার শ্রমমূল্য ঠিকই সমন্বয় করে নিবে। কিন্তু সমস্যায় রইবে একশ্রেণীর মানবক‚ল যারা নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং কিছু সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবী যারা অনৈতিক কর্মকান্ডে বিশ্বাসী নহে। তারা মান সম্মানের ভয়ে হয়তোবা নিভৃতকোণে বসে চোখের পানি ফেলবে। সংকট মোকাবেলায় চাইলে তো আর সরকার বা কর্তৃপক্ষ তাদের বেতন ভাতাদি বাড়িয়ে দিতে পারবে? তাই হয়তোবা ঐ শ্রেণীর মানবকুল খাওয়া কমিয়ে, শখ আহলাদ বিসর্জন দিয়ে বৌ বাচ্চার আবদার সুকৌশলে এভয়েড করে টিকে রইবে ভবিষ্যতের কোন আশায়।
স্বপ্নদ্রষ্টা স্বপ্ন বুনেছিলেন এ দেশ গড়বেন কিউবার আদলে। কিন্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কিছু নষ্ট নেতাদের ছত্রছায়ায় বা পৃষ্ঠপোষকতায় কিছু লুটেরা, দুস্কৃতিকারী পঁচাত্তর পরবর্তী তে স্বপ্নদ্রষ্টার সেই স্বপ্ন ছিনতাই করে নিয়ে গিয়েছেন।আর ফলস্বরূপ যা ঘটার তাই ঘটছে। তারপরও সোনার বাংলা তোমায় ভালবাসি।
লেখক: প্রাবন্ধিক