শখের বশে ছাগল পালন শুরু করেছিলেন কক্সবাজারের রামু উপজেলার পূর্ব নোনাছড়ি গ্রামের হারেছা বেগম। ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন একটি খামার, বর্তমানে যেখানে ৪০টি ছাগল রয়েছে। তবে কোনো পাঁঠা না থাকায় প্রজননের সময় ছাগলকে প্রায় ১৫-২০ কিলোমিটার দূরের অন্য একটি গ্রামে নিয়ে যেতে হয়। এতে ছাগলপ্রতি পরিবহন খরচসহ গুনতে হয় এক-দেড় হাজার টাকা। এমন নানা সংকটে প্রায় অর্ধেক ছাগলেরই প্রজননের সময় পার হয়ে যায়। আবার যেসব পাঁঠা পাওয়া যায় সেগুলোও ভালো জাতের নয়। অতি সংকরায়নের ফলে তার খামারের ছাগলগুলো এখন কোন জাতের তা বলা মুশকিল। আগের চেয়ে বেড়েছে রোগ-বালাইও।
কেবল হারেছা বেগমই নন, প্রায় সব জেলার ছাগল পালনকারীরাই এ সংকটে রয়েছেন। অনেকের সঙ্গেই কথা বলে জানা যায়, ছাগল পালনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে পাঁঠা সংকট। সামাজিক ও ধর্মীয় ভুল ধারণার কারণে মূলত খামারিরা পাঁঠা পালন করতে চান না। আবার চাহিদা বেশি থাকায় মর্দা ছাগলকে জন্মের কয়েক দিন পরই খাসি করিয়ে দেয়া হয়। সামাজিক অবজ্ঞা আর নানা কটুকথা উপেক্ষা করে কেউ কেউ পাঁঠা পালন করলেও বেশির ভাগই নিম্নমানের। তার পরও বিকল্প না থাকায় অনেক দূর-দূরান্ত থেকে এসব পাঁঠার কাছেই ছাগল নিয়ে ছুটতে হয় খামারিদের।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ছাগল উৎপাদন করা হলেও বাংলাদেশে সরকারিভাবে এ ব্যবস্থা নেই। লাভজনক না হওয়ায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও তেমন এগিয়ে আসছে না। এসব কারণে ছাগল উৎপাদনে দীর্ঘমেয়াদি সংকট তৈরি হচ্ছে বলে মনে করছেন প্রাণী বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) জেনেটিকস অ্যান্ড অ্যানিমেল ব্রিডিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া বলেন, ‘ছাগল উৎপাদনে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো দেশে গুণগত মানসম্পন্ন ও অধিক উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন পাঁঠা তৈরির কোনো উদ্যোগ নেই। বছরে বছরে বিজ্ঞানসম্মতভাবে পাঁঠার জাত উন্নয়ন করতে হয়। কিন্তু এ বিষয়েও সরকারি-বেসরকারি কোনো কার্যক্রম দেশে নেই। দ্বিতীয় সমস্যা হলো এক পাঁঠা দিয়ে যদি কোনো বাড়িতে বা এলাকায় এক বছরের বেশি প্রজনন করানো হয় তাহলে ইনব্রিডিং (অন্তঃপ্রজনন) হয়। অর্থাৎ রক্তের সম্পর্কের মধ্যে প্রজননের ফলে যে বাচ্চা জন্ম নিচ্ছে সেটাই ইনব্রিডিং। এতে বাচ্চার মৃত্যুহার বেড়ে যায়।
ড. ফজলুল হক বলেন, ‘সংখ্যা কমে আসায় এখন খামারিরা একই পাঁঠা দিয়ে সব ছাগলকে প্রজনন করাচ্ছেন। এতে অন্তঃপ্রজননের মাধ্যমে জন্ম নেয়া ছাগল রোগাক্রান্ত ও দুর্বল হয়ে পড়ছে। ফলে মাংস উৎপাদন কমে আসার পাশাপাশি ধীরে ধীরে জাতও অনুন্নত হতে থাকে।’
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে দেশে এক দশক আগে ছাগলের সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৫৪ লাখ। বর্তমানে রয়েছে প্রায় ২ কোটি ৭০ লাখ। এর মধ্যে ছাগলের নিবন্ধিত খামার রয়েছে ৫ হাজার ৪৭৯টি, যেখানে প্রায় পুরোটাই প্রাকৃতিক প্রজননের মাধ্যমে ছাগল উৎপাদন হয়।
দেশে ছাগলের সবচেয়ে জনপ্রিয় জাত ব্ল্যাক বেঙ্গল। জাতটিকে ভৌগোলিক নিদর্শন (জিআই) হিসেবে চলতি বছর স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এছাড়া যমুনাপাড়ি, হরিয়ানা, ব্রিটল, বারবারি, শিরোহীসহ বিভিন্ন জাতের ছাগল পালন করেন খামারিরা। যদিও ২০০৭ সালের প্রাণিসম্পদ নীতিমালা অনুযায়ী, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাড়া অন্য কোনো জাতের ছাগল প্রজননের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই।
ঢাকা, চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহী, ঝিনাইদহ, সিলেট, চট্টগ্রাম ও বরিশাল—এ সাত জেলায় সরকারি ছাগল উন্নয়ন খামার রয়েছে। যদিও এ খামারগুলো ছাগলের জাত উন্নয়নে কিংবা সম্প্রসারণে খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারছে না। বর্তমানে ছাগলের কৃত্রিম প্রজনন নিয়ে কাজ করে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক। তবে সরকারিভাবে ছাগলের কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রমটি খামারিদের মধ্যে বিস্তৃত নয়। আবার বেসরকারিভাবে সিমেন উৎপাদন করলেও লাভজনক না হওয়ায় তার পরিমাণ খুবই সামান্য। সাধারণত নতুন জাত বা জাতবিষয়ক যেকোনো বিষয়ে অনুমোদন দেয় জাতীয় কারিগরি নিয়ন্ত্রণ কমিটি (এনটিআরসি)। সংস্থাটির পক্ষ থেকে শুধু ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের সিমেন উৎপাদনের অনুমোদন রয়েছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাঁঠা সংকট ও ইনব্রিডিং ঠেকাতে সরকারিভাবে ছাগলের কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম শুরু করতে হবে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর অবশ্য ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের কৃত্রিম প্রজনন ও জাত উন্নয়নে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যদিও তা এখনো পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদন মেলেনি। প্রকল্পটির মাধ্যমে সারা দেশ থেকে পাঁঠা সংগ্রহ ও জাত উন্নয়নে কাজ করতে চায় এ অধিদপ্তর।
অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক বলেন, ‘বর্তমানে বিদেশী বিভিন্ন জাতের মাধ্যমে প্রজনন করানোর কারণে এসব জাত এখন পুরো বাংলাদেশ ছেয়ে যাচ্ছে। অথচ এগুলো সরকারিভাবে নিষিদ্ধ। এসব কারণে প্রাণিসম্পদ খাতের প্রচুর সম্ভাবনা থাকলেও এখন মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সরকারিভাবে যদি কোনো প্রকল্প নেয়া হয় সেক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মতভাবে জাত উন্নয়ন করতে হবে। আবার কৃত্রিম প্রজননের পদক্ষেপ নেয়া হলে বিশেষ করে নারীদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া জরুরি।’
এদিকে পাঁঠার অভাবে ছাগলের অর্ধেকই নির্ধারিত সময়ে প্রজনন করানো যায় না বলে জানান খামারিরা। নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার চর আতাউলের মামুনুর রশীদ গরু-মহিষের পাশাপাশি ছাগল-ভেড়া লালন-পালন করেন। তার খামারে শতাধিক ছাগল রয়েছে। তবে প্রজননের জন্য সেগুলো দূরে কোথাও নিয়ে যেতে হয় তাকে। বণিক বার্তাকে মামুন বলেন, ‘গরু-মহিষের যেভাবে কৃত্রিম প্রজনন করা যায় ছাগলের ক্ষেত্রে সে সুযোগ নেই। বেশির ভাগ সময় দেখা যায়, ছাগলের হিট (প্রজনন সময়) আসে। কিন্তু পাঁঠার অভাবে প্রজনন করানো সম্ভব হয় না। এ কারণে প্রায় অর্ধেক ছাগলকেই নির্ধারিত সময়ে প্রজনন করাতে পারি না। আবার পাঁঠা পাওয়া গেলেও ভালো মানের পাই না। এর কারণে বাচ্চাও রুগ্ণ-অসুস্থ থাকে।’
দেশে ছাগলের সিমেন উৎপাদনকারী একমাত্র বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক। ২০০০ সালের পর থেকে ছাগলের কৃত্রিম প্রজনন করছে সংস্থাটি। বছরে তারা ৭০-৮০ হাজার ডোজ সিমেন উৎপাদন করে। তাদের এখন প্রজনন সক্ষম পাঁঠা রয়েছে ২৫টির মতো। এক্ষেত্রে সফলতার হার ৫৫-৬০ শতাংশ। কৃত্রিম প্রজননসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গরুর ক্ষেত্রে কৃত্রিম প্রজনন লাভজনক হলেও ছাগলের ক্ষেত্রে তা এখনো লাভজনক হয়ে ওঠেনি। ফলে এতে আগ্রহ দেখান না প্রজননকর্মীরা।
ব্র্যাক আর্টিফিশিয়াল ইনসেমিনেশন এন্টারপ্রাইজের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ফারুকুল ইসলাম বলেন, ‘প্রাকৃতিক প্রজননের তুলনায় কৃত্রিম প্রজননে ছাগলের ক্ষেত্রে সফলতার হার কিছুটা কম। আবার প্রজননকর্মীরা গরুর প্রজননের জন্য যে টাকা পান ছাগলের ক্ষেত্রে তা অনেক কম। এ কারণে তারাও আগ্রহী হন না। ব্র্যাক যেহেতু অলাভজনক সে কারণে আমরা ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের কৃত্রিম প্রজনন ও জাত উন্নয়নে কাজ করছি। মানুষের কাছে আমরা প্রচার করছি। সরকারিভাবে কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম হাতে নেয়া হলে তা খুবই কার্যকর হবে। ছাগলের জাত উন্নয়ন করা হলে উৎপাদনশীলতা বাড়বে। আবার কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ইনব্রিডিংয়ের ঝুঁকি কমে আসবে।’
দেশের প্রাণিসম্পদ খাতের প্রধান চালিকাশক্তি নারী। বিশেষ করে গ্রামীণ নারীদের শ্রমে ভর করেই এগোচ্ছে এ খাত। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, প্রাণিসম্পদ খাতে নারীর অংশগ্রহণ ৮৮ দশমিক ২ ও পুরুষের কেবল ১১ দশমিক ৮ শতাংশ। এর মধ্যে নারীদের বড় একটি অংশ ছোট পরিসরে ছাগল লালন-পালন করে থাকেন। তবে প্রজননের জন্য ভালো পাঁঠা না পাওয়ায় অনেকেই খামার বন্ধ করে দিচ্ছেন।
নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার কালিকাপুর গ্রামের রুমানা আক্তার কয়েক বছর ধরে গড়ে পাঁচ-ছয়টি ছাগল লালন-পালন করে আসছিলেন। কিন্তু ভালো পাঁঠা না পাওয়ায় তিনি ছাগলগুলো গত বছর বিক্রি করে দেন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাড়িতে কয়েকটি ছাগল পালতাম। কিন্তু হিট এলে পাঁঠা পাওয়া যায় না। অন্য জায়গায় নিয়ে গেলে যাওয়া-আসা অনেক খরচ। এখন আগের মতো ভালো বাচ্চাও হয় না। এ কারণে ছাগলগুলো এক এক করে বিক্রি করে দিয়েছি।’
এদিকে সিলেট বিভাগের জেলাগুলোয়ও তীব্র পাঁঠার সংকট। চা বাগান শ্রমিকদের কাছে থাকা পাঁঠাই তাদের একমাত্র ভরসা। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার রহিমপুর ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর গ্রামের বাসিন্দা আমিরুন নেছা। তার তিনটি ছাগল রয়েছে। মাস খানেক আগে একটি ছাগলের প্রজনন সময় হয়। কিন্তু গ্রামে কোনো পাঁঠা নেই। ফলে তাকে লাগোয়া মিরতিংগা চা বাগানে পুজোর জন্য রাখা পাঁঠার কাছে ছাগলটি নিয়ে যেতে একজন লোককে আধাবেলার মজুরি দিয়ে পাঠাতে হয়। আমিরুন নেছা বলেন, ‘আমাদেরসহ আশপাশের কোনো গ্রামেই কোনো পাঁঠা নেই। চা বাগানে পুজোর পাঁঠাই এ অঞ্চলের খামারিদের একমাত্র ভরসা।’
ছাগল খামারিদের অনেকেই জানান, সামাজিক অবজ্ঞার কারণে পাঁঠা পালন করতে পারেন না তারা। এ বিষয়ে মৌলভীবাজারের রহিমপুর ইউনিয়নের শ্রীনাথপুর গ্রামের আবুল মিয়া বলেন, ‘বহুকাল আগ থেকে এ অঞ্চলে ছাগল ডাকে (প্রজনন সময়) এলে চা বাগানের পাঁঠার কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রচলন। স্থানীয়ভাবে কেউ পাঁঠা পালন করে না। আবার যারা পালন করেন তাদের নিচু জাত বলে অবজ্ঞা করা হয়। তাছাড়া এর মাংস খাওয়ার প্রচলন কম থাকায় বাজারে দাম পাওয়া যায় না। এ কারণেও কেউ পাঁঠা পালন করেন না।’
প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত দেড় দশকে দেশের বিভিন্ন স্থানে কিছু বাণিজ্যিক পাঁঠার খামার গড়ে ওঠে। অতিমুনাফার জন্য বিদেশী পাঁঠা দিয়ে সেখানে প্রজনন করানো হয়। এর পরই ছাগলে রোগ-বালাইয়ের প্রকোপ বেড়ে যায়। যদিও পরবর্তী সময়ে এসব খামারও বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এর মধ্যে স্থানীয় ব্ল্যাক বেঙ্গল জাত সংকরায়নের কারণে হুমকির মধ্যে পড়ে।
‘ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প ২০১৮-২২ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়ন করে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। প্রকল্পটির পরিচালক ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের খামার শাখার উপপরিচালক মো. শরিফুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশে ভালো জাতের পাঁঠার খুব বেশি সংকট। আমরা সরকারিভাবে যা দিচ্ছি তাও অপ্রতুল। এটাকে আরো বিস্তৃত করা উচিত। এছাড়া মানুষের মাঝে ছাগল পালনকে উৎসাহ দিতে হলে পাঁঠা পালনকেও উৎসাহ দিতে হবে। তবে যারা পাঁঠা পালন করবেন তাদের আইনি কাঠামোয় আনতে হবে, যেন নিয়মতান্ত্রিক প্রজনন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। আমাদের একটি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। সেখানে জাত উন্নয়নের জন্য যারা এক্সপার্ট রয়েছেন তাদের যুক্ত করার মাধ্যমে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের জাত উন্নয়ন করা হবে এবং তাদের সিমেন সংগ্রহ করে কৃত্রিম প্রজনন করা হবে।’
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য নেয়া হয়েছে বণিক বার্তার)