“আমরা মনে করি জিপিএ-৫ না পেলে জীবন বৃথা। যেকোনো ভাবেই হোক জিপিএ-৫ পেতে হবে। অভিভাবকরাও তাই সন্তান যাতে জিপিএ-৫ পায় সেজন্য ঘরবন্দি করে পড়ালেখা করান। অথচ জিপিএ-৫ মানে মেধাবী হওয়া নয়৷ অনেক শিক্ষার্থীই আছে যারা ক্লাসে খুব ভালো না করলেও খুবই সৃজনশীল। অভিভাবকদের সন্তানদের জিপিএ-৫ এর পেছনে লেগে না থেকে সে তার সক্ষমতা অনুযায়ী ফলাফল করল কিনা সেদিকে নজর রাখা উচিত।”
উপরের এই কথাগুলো আমার নয়। কথাগুলো বলেছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপুমনি। গত শুক্রবার প্রকাশিত হয়েছে এসএসসি , দাখিল ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল। এ বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার ও জিপিএ-৫ দুটোই কমেছে। এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় গড়ে পাস করেছে ৮০ দশমিক ৩৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। গতবার পাসের হার ছিল ৮৭ দশমিক ৪৪। এবার মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৮ জন। ২০২২ সালে জিপিএ-৫ পেয়েছিল ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন। ২০২২ ও ২০২৩ সালের পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, এবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার ও জিপিএ-৫ কমেছে।
এবার মূল কথায় আসা যাক। সাধারণত পরীক্ষার মধ্য দিয়ে একজন শিক্ষার্থীর মেধা যাচাই করা হয়। পরীক্ষার ফলাফল যদি ভালো হয় বা শিক্ষার্থী যদি তথাকথিত জিপিএ-৫ পায় তাহলে ধরে নেওয়া হয় সেই শিক্ষার্থী মেধাবী। আর কোনো কারণে যদি কোনো শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ না পায় তাহলে মনে করা হয় যেই ছাত্র বা ছাত্রী মেধাবী নয়। কিন্তু জিপিএ-৫ নামক যে ভয় আমরা সন্তানদের মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছি, তা তাদের মানসিকতায় কতটা ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে সেটা কি কখনো ভেবেছি?
আমাদের অভিভাবকদের জিপিএ-৫ রোগ হয়েছে। অনেকটা এমন যে সন্তান যদি জিপিএ-৫ না পায়, তিনি পাশের বাসার ভাবির সামনে মুখ দেখাতে পারবেন না। মা-বাবাদের বুঝতে হবে জীবনে জিপিএ-৫ পাওয়া মানের সব নয়। জীবনটা অনেক বড়। দয়া করে জিপিএ-৫ মধ্যে জীবনকে সীমাবদ্ধ রাখবেন না। আজকের মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল কিছুদিন পর কেউ জানতেও চাইবে না। শুধু এসএসসি নয় উচ্চমাধ্যমিকেও জিপিএ-৫ না পেয়ে রীতিমতো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে অনেকে। লেখা পড়ার পাশাপাশি অন্যান্য কার্যক্রমেও তাঁদের সফলতা ঈর্ষণীয়।
শিক্ষাবিদরা মনে করেন তথাকথিত ভালো ও খারাপ ফলাফল নিয়ে অভিভাবকদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ বিভাগের শিক্ষার্থী তৌহিদুল ইসলাম রাফি। এসএসসি পরিক্ষায় তার জিপিএ ছিল ৪.৩১ এবং এইচএসসি পরিক্ষায় জিপিএ ছিল ৪.৭৫। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রুবেলের এসএসসি পরিক্ষায় জিপিএ ছিল ৪.৫০ এবং এইচএসসি পরিক্ষায় জিপিএ ছিল ৪.৯০। রাফি বা রুবেলের মতো শত শত শিক্ষার্থীর দৃষ্টান্ত আমরা দেখাতে পারি যারা জিপিএ-৫ না পেয়েও সফল হয়েছে। তারা দেখিয়ে দিয়েছে জিপিএ-৫ না পাওয়া মানেই সব শেষ হয়ে যাওয়া নয়। তারা দেখিয়ে দিয়েছে এভাবে ফিরে আসা যায়। প্রমাণ করেছে সঠিক শিক্ষা ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকলে সফলতা আসবেই।
জিপিএ-৫ মানেই মেধাবী নয়
মুদ্রার উলটা পিঠও আছে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক উভয় পরিক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েও কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাইনি এমন হাজারো শিক্ষার্থী আছে। অভিভাবকদের এগুলো বুঝতে হবে। তারা যখন সন্তানদের জিপিএ-৫ পেতেই হবে এমন কথা বলেন, সেটা অনেকটা মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। তখন সন্তানরা পড়াটাকে উপভোগ করতে পারে না। সব সময় জিপিএ-৫ এর অশুভ আত্মা যন্ত্রণা দেয়। যা বাধাগ্রস্ত করে স্বাভাবিক শিক্ষা ও মানসিক বিকাশকে।
আমাদের বুঝতে হবে পাঠ্য বইয়ের বাহিরেও একজন শিক্ষার্থীর অনেক কিছু জানার আছে , অনেক কিছু শেখার আছে। জিপিএ-৫ শুধু পাঠ্য বই কেন্দ্রিক। জিপিএ-৫ পেতে গিয়ে সন্তান বাহিরের বিশাল জগৎকে হাড়াচ্ছে কিনা সে খবর কি আমরা রেখেছি? আমি বলছি না যে জিপিএ-৫ বা তথাকথিত এ প্রাস না পেলেও হবে। তবে এ প্লাস কখনো মেধা মাপকাঠি হতে পারে না। জিপিএ-৫ না পেলে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিব, প্রায়ই এমন কথা অভিভাবকদের কণ্ঠে স্থান পায়। ফলে কোনো কারণে যদি ফলাফল জিপিএ-৫ না আসে ছেলে-মেয়েরা ভয়ে নানা রকম বিপজ্জনক সিদ্ধান্তের দিকে ধাবিত হয়। প্রায় প্রতি বছর পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার সংবাদ পাওয়া যায়। এর দায় কি অভিভাবকরা এড়াতে পারবে?
মাধ্যমিক পরীক্ষা ২০২০–এর ফলাফল প্রকাশ হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২১ জন কিশোর-কিশোরী আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এদের মধ্যে ১৯ জনই ছিল কিশোরী। একই বছর জানুয়ারি মাসে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও নিম্ন মাধ্যমিকের (জেএসসি) সমাপনী পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলে ১৭ জন শিশু আত্মহত্যা করে। এখানে আনুপাতিক হারে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। ১৭ শিশুর ১০ জনই ছিল মেয়ে। এই পরিসংখ্যানগুলো সাধারণ কোনো তথ্য নয়। একটি জাতির ভবিষ্যৎ সেই শিক্ষার্থী তারাই কিনা আত্মহত্যার মতো চরম ভয়াবহ পথ বেছে নিচ্ছে। বার বার অভিভাবকদের প্রসঙ্গ চলে আসে। কারণ তো তারাই পারে নিজেদের সন্তানকে অভয় দিতে। তোমাকে জিপিএ-৫ পেতে হবে না। তুমি মন দিয়ে পড়, প্রকৃত শিক্ষা লাভ কর। এমন কথা খুব কম মা-বাবাই তাদের সন্তানদের বলেছে। যদি সব বাবা-মা সন্তানদের এমন উৎসাহ দিত, তাহলে ফলাফল কাঙ্ক্ষিত না হওয়ার পর আর কোনো প্রদীপ নিভে যেত না।
আসুন সচেতন হই। সাময়িক কোনো বিষয়কে মেধা যাচাইয়ের মাপকাঠি না বানিয়ে প্রকৃত শিক্ষা অর্জনে সন্তানদের উৎসাহ দেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরীন বলেছেন “আপনি একজন ভালো সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। আপনার সন্তানের জীবন আপনার কাছে নিশ্চয় জিপিএ-৫ এর চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।” তাই সচেতনতা শুরু হোক আমি আর আপনি থেকে। আর একটি প্রদ্বীপও যেন অকালে নিভে না যায় এখন থেকেই সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী