ঢাকা ১২:০৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘হাফ পাস’ শিক্ষার্থীদের আবদার নয় অধিকার

সোহরাব শান্ত : গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের জন্য ‘হাফ পাস’ বা অর্ধেক ভাড়া নির্ধারণের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে রাজধানীর ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থী ও পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে।

Model Hospital

চলতি মাসে (নভেম্বর) তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়। বর্ধিত ভাড়ার মধ্যে কিছুদিন ধরে শিক্ষার্থীরা তাদের জন্য অর্ধেক ভাড়া চালুর দাবি জানাচ্ছে। তারা রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ মোড় ও সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছে। গত রোববারও (২১ নভেম্বর) বিক্ষোভ-অবরোধ ছিল ঢাকার বিভিন্ন সড়কে। কিন্তু দাবি মানার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কোনো উচ্চবাচ্য শোনা যায়নি।

হাফ বা অর্ধেক ভাড়া নিয়ে তর্কাতর্কির জেরে ঢাকার বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়ার অভিযোগে একটি বাসের চালকের সহকারী (হেলপার) ও চালককে রোববার আটক করেছে র‌্যাব। এর আগে অভিযুক্ত হেলপার-চালকের গ্রেফতার ও ‘হাফ পাস’ নির্ধারণের দাবিতে ওই কলেজের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয়। অভিযুক্ত আটক হলেও তাদের মূল দাবি এখনো পূরণ হয়নি। ‘হাফ পাস’ নির্ধারণ দেশের সকল শিক্ষার্থীরই চাওয়া বলে আমরা মনে করি।

হাফ পাসের দাবির বিষয়টি নতুন কোনো বিষয় নয়, পুরনো বচসা নতুন রূপে ফিরে এসেছে। ইতিহাস বলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভেরও আগে, পাকিস্তান আমলে এ দেশে শিক্ষার্থীরা যানবাহনে হাফ ভাড়া দেওয়ার অধিকার পেয়ে এসেছে। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে বিষয়টি নিয়ে গণ-পরিবহন; বিশেষত ঢাকা শহরের কোনো কোনো পরিবহন কোম্পানির তথাকথিত সিটিং সার্ভিসগুলোতে হাফ ভাড়া না রাখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ নিয়ে নানা সময়ে ঘটেছে অপ্রীতিকর ঘটনা। যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষার্থীদের ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন’- এর ৯ দফা দাবির মধ্যেও হাফ ভাড়ার বিষয়টি ছিল।

বদরুন্নেসার শিক্ষার্থীরা রোববার মাঠে নামায় আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হলো। তবে এর কয়েকদিন আগে থেকেই হাফ পাস বা অর্ধেক ভাড়ার দাবিতে আন্দোলন চলছে। সম্প্রতি (১৫ নভেম্বর সোমবার) রাজধানীর আফতাবনগরে অবস্থিত ইম্পেরিয়াল কলেজের এক শিক্ষার্থী ‘রাইদা পরিবহন’-এর একটি বাসে ‘হাফ ভাড়া’ দিতে চাইলে কথা কাটাকাটি ও তর্কতর্কি হয়। এক পর্যায়ে ওই শিক্ষার্থীকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বাস থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। ওই ঘটনার জের ধরে রামপুরা ব্রিজে অবস্থান নেয় কলেজটির শিক্ষার্থীরা। তারা রাইদা পরিবহনের অন্তত ৫০টি বাস আটকে দেয়। ফলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয় রাইদা কর্তৃপক্ষ। থানায় বসে চলা ওই আলোচনায় মালিকপক্ষ কথা দেয় ইম্পেরিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নেওয়া হবে।

পরবর্তীকালে মহাখালীর তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা হাফ পাসের দাবিতে মাঠে নামে। তারা রাইদা পরিবহেনর প্রতিটি বাসের গায়ে ‘হাফ পাস আছে’ কথাটি লিখে দেয়। প্রসঙ্গত, রাজধানীতে চলাচলকারী অনেক পরিবহন সার্ভিসের বাসে লেখা দেখা যায়- ‘হাফ পাস নাই’। তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা বিষয়টাকে উল্টে দেয়। প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক- হাফ পাস বা অর্ধেক ভাড়া দেওয়া শিক্ষার্থীদের আবদার নাকি অধিকার? সেদিকে যাওয়ার আগে হাফ ভাড়া নিয়ে প্রচলিত একটি কৌতুক উল্লেখ করা যেতে পারে।

যাত্রীবাহী ট্রলারে করে কয়েকজন শিক্ষার্থী যাচ্ছে। ভাড়া আদায়কারী ভাড়ার টাকা তুলতে এলো। স্কুলগামী এক শিক্ষার্থী অর্ধেক ভাড়া দিয়ে বলল- স্টুডেন্ট। আরেক শিক্ষার্থীর কাছে যাওয়ার পর সে-ও দিল অর্ধেক। তৃতীয় শিক্ষার্থীর কাছে ভাড়া চাইলে সে-ও দিল অর্ধেক। ভাড়া আদায়কারী জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে তাকালে ওই শিক্ষার্থী বলল, স্টুডেন্ট। হাফ। ভাড়া আদায়কারী কথা না বাড়িয়ে পরের জনের কাছে গেলেন, যিনি মধ্যবয়সী এক রসিক মানুষ। ভাড়া আদায়কারী ভাড়ার জন্য হাত বাড়াতেই তিনি পান খাওয়া মুখে হেসে বললেন, আমি ছাত্রদের বাপ। আমার ভাড়া তো মাফ!

কৌতুকের সেই ব্যক্তি যিনি সম্মানের দিক দিয়ে শিক্ষার্থীদের বাপ সমতুল্য, তার ভাড়া মাফ হয়েছিল কি না আমরা জানি না, তবে ছাত্রদের কাছ থেকে ভাড়া অর্ধেক নেওয়া হয়েছিল সেটি পরিষ্কার। বছরের পর বছর ধরে আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার এই রীতি চলে এসেছে। শিক্ষার্থীদের নিজস্ব আয় থাকে না। তারা অভিভাবকদের দেওয়া হাত খরচের ওপর নির্ভরশীল। হাফ ভাড়া দিয়ে যাতায়াত করতে পারলে তাদের শিক্ষার খরচ কিছুটা হলেও কমে, চাপ কমে অভিভাবকদের।

হ্যাঁ, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে গণপরিবহনে অর্ধেক ভাড়া নেওয়া রীতি বটে। আইন নয়। যদিও হাফ পাসের বিষয়টিকে অধিকার হিসেবে দেখে আসছে শিক্ষার্থীরা। আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেই নয়, অনেক দেশেই এ ব্যবস্থা আছে বলে ঢাকার একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ (নিসচা)-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন।

বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুসারে, ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের হাত ধরে আসা ১১ দফা দাবির একটি ছিল ‘হাফ ভাড়া’ নির্ধারণ। পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের ঘোষিত এই ১১ দফা দাবির একটি ছিল শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়া রাখা। দাবির ১ (ঢ) দফা অনুসারে, ‘ট্রেনে, স্টিমারে ও লঞ্চে ছাত্রদের “আইডেন্টিটি কার্ড” দেখাইয়া শতকরা পঞ্চাশ ভাগ “কন্সেসনে” (ছাড়ে) টিকিট দেওয়ার ব্যবস্থা করিতে হইবে। মাসিক টিকিটেও “কন্সেসন” দিতে হইবে।’

বাস্তবতা হলো- স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা অনেকটা রীতি হিসেবে এতদিন গণপরিবহনে অর্ধেক ভাড়া দিয়ে আসলেও কোনো কোনো পরিবহন কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের এই অধিকারের প্রতি অবজ্ঞা করে আসছিল। বিশেষ করে ঢাকা শহরের তথাকথিত ‘সিটিং সার্ভিস’ তকমা লাগানো অধিকাংশ বাস শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি তোয়াক্কা করছিল না। উল্টো হাফ ভাড়ার দাবি তোলা শিক্ষার্থীদের তারা হয়রানি করছিল। এ নিয়ে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটেছে।

দুঃখজনক হলেও সত্য, সর্বশেষ সবচেয়ে বড় ছাত্র আন্দোলন; ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের অন্যতম দাবি মানা হয়নি। শিক্ষার্থীদের কঠিন আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপদ সড়ক আইন পাস হয়, উপেক্ষিত থাকে হাফ পাসের বিষয়টি। যদিও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের একবার মৌখিকভাবে হাফ পাস কার্যকরের নির্দেশ দিয়েছিলেন। আইন না মানার মানসিকতা লালন করা আমরা মৌখিক নির্দেশের তোয়াক্কা করিনি। মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অর্থাৎ দলটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি। কিন্তু পরিবহন মালিকরা তার কথা কানেও তোলেনি। তাহলে কি আমরা ধরে নেব পরিবহন মালিকরা আরও বেশি শক্তিশালী!

আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। এ ধরনের পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা থাকা জরুরি। এ ব্যাপারে সরকারকে নীতিমালা তৈরিসহ আইন প্রণয়ন করতে হবে। শুধু আইন তৈরি নয়, তা বাস্তবায়নে কঠোর নজরদারিও প্রয়োজন। শিক্ষার্থীরা নির্বিঘ্নে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াতসহ শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ পেলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হবে যোগ্য ও দক্ষ। দ্রব্যমূল্যেও ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে যাতায়াতের ভাড়ার কারণে গরিব কোনো শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বন্ধ হলে এটা হবে আমাদের সবার লজ্জার কারণ।

এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা উচিত। সেটা হলো পরিবহন শ্রমিকদের স্বার্থ। দেশের পিছিয়ে পড়া নিম্ন আয়ের একটা অংশ পরিবহন সেক্টরে শ্রম দেন। ‘হাফ পাস’ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যেন তাদের পেটে লাথি না পড়ে সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ বাস মালিকদের কাছ থেকে দৈনিক চুক্তিতে বাস এনে রাজধানীতে বাস চালান ড্রাইভার-কনট্রাকটর-হেলপাররা। জমার টাকা উঠিয়ে তারপর যা আয় হয় সেটা ভাগ হয় এই তিনজনের মধ্যে। এতে কোনো বাসে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী উঠলে তা বাস শ্রমিকদের রুটি-রুজিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই ‘হাফ পাস’-এর নীতিমালা বা আইনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে শিক্ষার্থীরা কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা শিক্ষাসংশ্লিষ্ঠ কাজে যাতায়াতকালে বৈধ পরিচয়পত্র প্রদর্শন সাপেক্ষে অর্ধেক ভাড়া দেবে। এছাড়া দৈনিক হাজিরা অথবা মাসিক বেতনের ভিত্তিতে বাসের চালক-হেলপার নিয়োগে বাস মালিকদের বাধ্য করার বিধান রাখা যেতে পারে। এতে চালক-কন্ট্রাকটর-হেলপাররা ‘যে কোনো মূল্যে’ বাড়তি ভাড়া আদায়ে মরিয়া হবে না।

আমরা আশা করতে পারি- সরকার দ্রুত শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়ে ‘হাফ পাস’ কার্যকর করবে। তা না হলে ক্ষোভের এই ছাইচাপা আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়তে পারে। যেমনটা ছড়িয়ে পড়েছিল ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়।

আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের শেণিকক্ষে বা ক্যাম্পাসে দেখতে চাই, রাজপথে নয়। করোনা মহামারির দীর্ঘ বন্ধের পর তাদের শ্রেণিকক্ষে থাকা খুব জরুরি। পড়াশোনার এমনিতেই অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। আর ক্ষতি কাম্য নয়।

লেখক: গল্পকার ও সাংবাদিক

ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ

ওমরাহ হজ্ব পালনে স্ব-পরিবারে সৌদি গেলেন মোশাররফ হোসেন

‘হাফ পাস’ শিক্ষার্থীদের আবদার নয় অধিকার

আপডেট সময় : ১২:৩৯:১২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ নভেম্বর ২০২১

সোহরাব শান্ত : গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের জন্য ‘হাফ পাস’ বা অর্ধেক ভাড়া নির্ধারণের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে রাজধানীর ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থী ও পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে।

Model Hospital

চলতি মাসে (নভেম্বর) তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়। বর্ধিত ভাড়ার মধ্যে কিছুদিন ধরে শিক্ষার্থীরা তাদের জন্য অর্ধেক ভাড়া চালুর দাবি জানাচ্ছে। তারা রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ মোড় ও সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছে। গত রোববারও (২১ নভেম্বর) বিক্ষোভ-অবরোধ ছিল ঢাকার বিভিন্ন সড়কে। কিন্তু দাবি মানার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কোনো উচ্চবাচ্য শোনা যায়নি।

হাফ বা অর্ধেক ভাড়া নিয়ে তর্কাতর্কির জেরে ঢাকার বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়ার অভিযোগে একটি বাসের চালকের সহকারী (হেলপার) ও চালককে রোববার আটক করেছে র‌্যাব। এর আগে অভিযুক্ত হেলপার-চালকের গ্রেফতার ও ‘হাফ পাস’ নির্ধারণের দাবিতে ওই কলেজের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয়। অভিযুক্ত আটক হলেও তাদের মূল দাবি এখনো পূরণ হয়নি। ‘হাফ পাস’ নির্ধারণ দেশের সকল শিক্ষার্থীরই চাওয়া বলে আমরা মনে করি।

হাফ পাসের দাবির বিষয়টি নতুন কোনো বিষয় নয়, পুরনো বচসা নতুন রূপে ফিরে এসেছে। ইতিহাস বলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভেরও আগে, পাকিস্তান আমলে এ দেশে শিক্ষার্থীরা যানবাহনে হাফ ভাড়া দেওয়ার অধিকার পেয়ে এসেছে। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে বিষয়টি নিয়ে গণ-পরিবহন; বিশেষত ঢাকা শহরের কোনো কোনো পরিবহন কোম্পানির তথাকথিত সিটিং সার্ভিসগুলোতে হাফ ভাড়া না রাখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ নিয়ে নানা সময়ে ঘটেছে অপ্রীতিকর ঘটনা। যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষার্থীদের ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন’- এর ৯ দফা দাবির মধ্যেও হাফ ভাড়ার বিষয়টি ছিল।

বদরুন্নেসার শিক্ষার্থীরা রোববার মাঠে নামায় আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হলো। তবে এর কয়েকদিন আগে থেকেই হাফ পাস বা অর্ধেক ভাড়ার দাবিতে আন্দোলন চলছে। সম্প্রতি (১৫ নভেম্বর সোমবার) রাজধানীর আফতাবনগরে অবস্থিত ইম্পেরিয়াল কলেজের এক শিক্ষার্থী ‘রাইদা পরিবহন’-এর একটি বাসে ‘হাফ ভাড়া’ দিতে চাইলে কথা কাটাকাটি ও তর্কতর্কি হয়। এক পর্যায়ে ওই শিক্ষার্থীকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বাস থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। ওই ঘটনার জের ধরে রামপুরা ব্রিজে অবস্থান নেয় কলেজটির শিক্ষার্থীরা। তারা রাইদা পরিবহনের অন্তত ৫০টি বাস আটকে দেয়। ফলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয় রাইদা কর্তৃপক্ষ। থানায় বসে চলা ওই আলোচনায় মালিকপক্ষ কথা দেয় ইম্পেরিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নেওয়া হবে।

পরবর্তীকালে মহাখালীর তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা হাফ পাসের দাবিতে মাঠে নামে। তারা রাইদা পরিবহেনর প্রতিটি বাসের গায়ে ‘হাফ পাস আছে’ কথাটি লিখে দেয়। প্রসঙ্গত, রাজধানীতে চলাচলকারী অনেক পরিবহন সার্ভিসের বাসে লেখা দেখা যায়- ‘হাফ পাস নাই’। তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা বিষয়টাকে উল্টে দেয়। প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক- হাফ পাস বা অর্ধেক ভাড়া দেওয়া শিক্ষার্থীদের আবদার নাকি অধিকার? সেদিকে যাওয়ার আগে হাফ ভাড়া নিয়ে প্রচলিত একটি কৌতুক উল্লেখ করা যেতে পারে।

যাত্রীবাহী ট্রলারে করে কয়েকজন শিক্ষার্থী যাচ্ছে। ভাড়া আদায়কারী ভাড়ার টাকা তুলতে এলো। স্কুলগামী এক শিক্ষার্থী অর্ধেক ভাড়া দিয়ে বলল- স্টুডেন্ট। আরেক শিক্ষার্থীর কাছে যাওয়ার পর সে-ও দিল অর্ধেক। তৃতীয় শিক্ষার্থীর কাছে ভাড়া চাইলে সে-ও দিল অর্ধেক। ভাড়া আদায়কারী জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে তাকালে ওই শিক্ষার্থী বলল, স্টুডেন্ট। হাফ। ভাড়া আদায়কারী কথা না বাড়িয়ে পরের জনের কাছে গেলেন, যিনি মধ্যবয়সী এক রসিক মানুষ। ভাড়া আদায়কারী ভাড়ার জন্য হাত বাড়াতেই তিনি পান খাওয়া মুখে হেসে বললেন, আমি ছাত্রদের বাপ। আমার ভাড়া তো মাফ!

কৌতুকের সেই ব্যক্তি যিনি সম্মানের দিক দিয়ে শিক্ষার্থীদের বাপ সমতুল্য, তার ভাড়া মাফ হয়েছিল কি না আমরা জানি না, তবে ছাত্রদের কাছ থেকে ভাড়া অর্ধেক নেওয়া হয়েছিল সেটি পরিষ্কার। বছরের পর বছর ধরে আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার এই রীতি চলে এসেছে। শিক্ষার্থীদের নিজস্ব আয় থাকে না। তারা অভিভাবকদের দেওয়া হাত খরচের ওপর নির্ভরশীল। হাফ ভাড়া দিয়ে যাতায়াত করতে পারলে তাদের শিক্ষার খরচ কিছুটা হলেও কমে, চাপ কমে অভিভাবকদের।

হ্যাঁ, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে গণপরিবহনে অর্ধেক ভাড়া নেওয়া রীতি বটে। আইন নয়। যদিও হাফ পাসের বিষয়টিকে অধিকার হিসেবে দেখে আসছে শিক্ষার্থীরা। আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেই নয়, অনেক দেশেই এ ব্যবস্থা আছে বলে ঢাকার একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ (নিসচা)-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন।

বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুসারে, ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের হাত ধরে আসা ১১ দফা দাবির একটি ছিল ‘হাফ ভাড়া’ নির্ধারণ। পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের ঘোষিত এই ১১ দফা দাবির একটি ছিল শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়া রাখা। দাবির ১ (ঢ) দফা অনুসারে, ‘ট্রেনে, স্টিমারে ও লঞ্চে ছাত্রদের “আইডেন্টিটি কার্ড” দেখাইয়া শতকরা পঞ্চাশ ভাগ “কন্সেসনে” (ছাড়ে) টিকিট দেওয়ার ব্যবস্থা করিতে হইবে। মাসিক টিকিটেও “কন্সেসন” দিতে হইবে।’

বাস্তবতা হলো- স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা অনেকটা রীতি হিসেবে এতদিন গণপরিবহনে অর্ধেক ভাড়া দিয়ে আসলেও কোনো কোনো পরিবহন কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের এই অধিকারের প্রতি অবজ্ঞা করে আসছিল। বিশেষ করে ঢাকা শহরের তথাকথিত ‘সিটিং সার্ভিস’ তকমা লাগানো অধিকাংশ বাস শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি তোয়াক্কা করছিল না। উল্টো হাফ ভাড়ার দাবি তোলা শিক্ষার্থীদের তারা হয়রানি করছিল। এ নিয়ে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটেছে।

দুঃখজনক হলেও সত্য, সর্বশেষ সবচেয়ে বড় ছাত্র আন্দোলন; ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের অন্যতম দাবি মানা হয়নি। শিক্ষার্থীদের কঠিন আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপদ সড়ক আইন পাস হয়, উপেক্ষিত থাকে হাফ পাসের বিষয়টি। যদিও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের একবার মৌখিকভাবে হাফ পাস কার্যকরের নির্দেশ দিয়েছিলেন। আইন না মানার মানসিকতা লালন করা আমরা মৌখিক নির্দেশের তোয়াক্কা করিনি। মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অর্থাৎ দলটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি। কিন্তু পরিবহন মালিকরা তার কথা কানেও তোলেনি। তাহলে কি আমরা ধরে নেব পরিবহন মালিকরা আরও বেশি শক্তিশালী!

আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। এ ধরনের পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা থাকা জরুরি। এ ব্যাপারে সরকারকে নীতিমালা তৈরিসহ আইন প্রণয়ন করতে হবে। শুধু আইন তৈরি নয়, তা বাস্তবায়নে কঠোর নজরদারিও প্রয়োজন। শিক্ষার্থীরা নির্বিঘ্নে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াতসহ শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ পেলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হবে যোগ্য ও দক্ষ। দ্রব্যমূল্যেও ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে যাতায়াতের ভাড়ার কারণে গরিব কোনো শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বন্ধ হলে এটা হবে আমাদের সবার লজ্জার কারণ।

এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা উচিত। সেটা হলো পরিবহন শ্রমিকদের স্বার্থ। দেশের পিছিয়ে পড়া নিম্ন আয়ের একটা অংশ পরিবহন সেক্টরে শ্রম দেন। ‘হাফ পাস’ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যেন তাদের পেটে লাথি না পড়ে সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ বাস মালিকদের কাছ থেকে দৈনিক চুক্তিতে বাস এনে রাজধানীতে বাস চালান ড্রাইভার-কনট্রাকটর-হেলপাররা। জমার টাকা উঠিয়ে তারপর যা আয় হয় সেটা ভাগ হয় এই তিনজনের মধ্যে। এতে কোনো বাসে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী উঠলে তা বাস শ্রমিকদের রুটি-রুজিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই ‘হাফ পাস’-এর নীতিমালা বা আইনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে শিক্ষার্থীরা কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা শিক্ষাসংশ্লিষ্ঠ কাজে যাতায়াতকালে বৈধ পরিচয়পত্র প্রদর্শন সাপেক্ষে অর্ধেক ভাড়া দেবে। এছাড়া দৈনিক হাজিরা অথবা মাসিক বেতনের ভিত্তিতে বাসের চালক-হেলপার নিয়োগে বাস মালিকদের বাধ্য করার বিধান রাখা যেতে পারে। এতে চালক-কন্ট্রাকটর-হেলপাররা ‘যে কোনো মূল্যে’ বাড়তি ভাড়া আদায়ে মরিয়া হবে না।

আমরা আশা করতে পারি- সরকার দ্রুত শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়ে ‘হাফ পাস’ কার্যকর করবে। তা না হলে ক্ষোভের এই ছাইচাপা আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়তে পারে। যেমনটা ছড়িয়ে পড়েছিল ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়।

আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের শেণিকক্ষে বা ক্যাম্পাসে দেখতে চাই, রাজপথে নয়। করোনা মহামারির দীর্ঘ বন্ধের পর তাদের শ্রেণিকক্ষে থাকা খুব জরুরি। পড়াশোনার এমনিতেই অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। আর ক্ষতি কাম্য নয়।

লেখক: গল্পকার ও সাংবাদিক