উচ্চশিক্ষা নিয়েও অনেক নারী চাকরি করার ফুসরত পান না। পড়াশোনা শেষ করে তারা সংসার সামলান। ফলে চাকরি করে স্বাবলম্বী হওয়ার যে স্বপ্ন সেটা অধরাই থেকে যায়। কিন্তু কিছু কিছু নারী আছেন যারা অদম্য। স্বামী, সংসার, সন্তানদের দেখভাল করেও তারা ঘরে বসেই স্বাবলম্বী হতে চান।
“মেধাকে কাজ লাগিয়ে নিজের চেষ্টায় হয়ে ওঠেন অনুকরণীয়। এদেরই একজন মাহমুদা ইয়াসমিন সাবিকা। যিনি ঘরে তৈরি করা খাবার অনলাইনে বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। পঁচিশ পার হওয়া এই নারী এখন অনেকেরই আদর্শ। এমনই একজন সফল নারী উদ্যোক্তার গল্প জানাচ্ছেন মো. মাসুদ হোসেন”
বগুড়া সদর উপজেলার দত্তবাড়ি এলাকার মেয়ে মাহমুদা ইয়াসমিন সাবিকা। দুই ভাই-বোনের মধ্যে ছোট সাবিকা ২০১৩ সালে এসএসসি পাশ করেন নিজ এলাকার কাটনার সেন্ট্রাল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। পড়াশোনার একপর্যায়ে অনার্স ৩য় বর্ষে থাকাকালীন ২০১৮ সালে পছন্দের এক বেকার ছেলের সাথে বিয়ে হয় তার। কর্মহীন ছেলেকে বিয়ে করায় মেনে নেয়নি সাবিকার পরিবার। এরমধ্যে তাদের দুজনের সাংসারিক জীবন কাটাতে হচ্ছে অর্থ সংকটের মধ্য দিয়ে। স্বামীর বেকারত্ব আর সাংসারিক খরচ মেটাতে না পেরে দুঃচিন্তায় পড়ে যান পড়াশোনা জানা এই নারী। কোন উপায় না পেয়ে আগ্রহের বসে খাবারের উপর প্রশিক্ষণ নেয়া ব্যবসা করার ইচ্ছে জাগে তার।
বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে খাবারের প্রচার শুরু করে দেন তিনি। হঠাৎ একদিন সবজি সিঙ্গারার অর্ডার পান এই নারী। মায়ের কাছ থেকে ধার নেয়া ৪০০ টাকা দিয়ে শুরু করেন সিঙ্গারা তৈরির কাজ। দ্রুত সময়ে রুচি সম্মত এই খাবারটি ডেলিভারি দিয়ে প্রশংসিত হন ক্রেতার কাছ থেকে। সাবিকার এই ব্যবসার প্রচার যখন বগুড়বাসীর কাছে পৌঁছতে থাকে তখন নিজ পরিবার, আত্মীয়স্বজন সহ প্রতিবেশীরা বিষয়টি ভিন্ন চোখে দেখতো। সাহস জোগানোর পরিবর্তে কটুক্তি করতে থাকে সবাই। ২০১৯ সালে শুরু করা ব্যবসার কয়েক মাস পর সারা বিশ্বের ন্যায় আমাদের দেশেও নেমে আসে মহামারী করোনা ভাইরাস। বেকার স্বামীর অনুপ্রেরণায় ঘরবন্দী এই সময়ে দুজনে মিলে ব্যবসার পরিধি বাড়াতে থাকেন তারা। একসময় সাবিকার এই ব্যবসার লভ্যাংশ থেকে চলতে থাকে তাদের দুজনের সাংসারিক জীবন। করোনা পরবর্তী সময়ে দেশ যখন কিছুটা স্বস্তিতে ফিরে আসে তখন একটি কোচিং সেন্টারে ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন সাবিকার স্বামী ওমর ফারুক।
খাবারের উপর টিএমএসএস থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করা শখের ব্যবসার জন্য প্রথমে নয় হাজার ও পরবর্তীতে ৫০ হাজার টাকা সরকারি অনুদান পান এই নারী উদ্যোক্তা। ক্রমান্বয়ে তার ব্যবসার এমন সফলতায় পরিবার সহ সবাই খুঁশি। এরমধ্যে বগুড়া আজিজুল হক কলেজ থেকে সমাজকর্মের উপর মাস্টার্স পাশ করেন সাবিকা। sabika’s food Shop নামে প্রায় ৫ হাজারের ফলোয়ারের ফেসবুক পেজে চলে তার ব্যবসার চাকা। কাস্টমাইজ দেশি খাবার, পোলাও, বিরিয়ানি, খিচুড়ি প্যাকেজ, বিভিন্ন স্ন্যাকস আইটেম, ডের্জাট আইটেম, শীতের পিঠা, গরুর মাংসের আচার সহ প্রায় ৩০ ধরনের খাবার নিয়ে কাজ করছেন এই নারী। তার এই ব্যবসায় নিয়োজিত আছেন ৬ জন সহযোগী।
শূণ্য থেকে উঠে আসা শিক্ষিত এই নারী উদ্যোক্তা এখন প্রতি মাসে আয় করছেন প্রায় ৪৫ হাজার টাকার মত। হোমমেড খাবার তৈরি করে এবং যথাসময়ে ভোক্তার কাছে পৌঁছে দিয়ে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছেন বগুড়াবাসীর কাছে। বিভিন্ন মেলায় অংশগ্রহণ করে অর্জন করেছেন সম্মাননা। খাবারের উপর প্রায় ৮-১০টি প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষতা ও সুনামের সাথে ঘরে বসেই ব্যবসা করছেন সাবিকা। মেয়ের এমন সাফল্যে গর্বিত বাবা নাসিমুল গনি। মেনে নিয়েছেন তাদের বিয়ে।
সফলতার পেছনে তার ব্যার্থতার কথা তুলে ধরে মাহমুদা ইয়াসমিন সাবিকা বলেন, এতো বছরের ব্যবসায় ব্যার্থতা যেমন ছিলো সফলতাও তেমন পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ। তবে অন্য ১০ জন নারীর মতো বিয়ের পর বাচ্চা নেওয়ার পরিকল্পনা নিতে পারিনি আমি। প্রথমে অভাবের সংসার ও পরে স্বাবলম্বী না হতে পারার কারনে এই স্বপ্নকে পিছিয়ে দিতে হয়েছে। কেননা ব্যবসার প্রথম দিকে পরিবার সহ প্রতিটি মানুষের কাছ থেকে পেয়েছি বাঁধা এবং হতাশামূলক কথা। সামাজিকভাবে প্রথম পর্যায়ে নারী হয়ে এমন কাজ কখনো ভালো চোখে দেখেনি কেউ। কিন্তু বর্তমানে পারিবারিক সকল বাঁধা পেরিয়ে সামাজিকভাবেও অনেক সন্মান পাচ্ছি।
তিনি বলেন, বিভিন্ন সামাজিক ক্ষেত্রে সফল নারী উদ্যেক্তা হিসেবে আমি স্বীকৃতি পেয়েছি। পরিবারে এখন আমার সন্মান এবং মূল্যায়ন অনেক বেশি যা অন্য ১০ জন সাধারণ নারী পেয়ে থাকেনা। একটি কর্ম আজ আমাকে ব্যার্থতা যেমন দিয়েছে তেমনি সময়ের সাথে সেসব ব্যর্থতা কাটিয়ে সফলতার শিখরে নিয়ে এসেছে।
সাবিকা বলেন, ‘ব্যবসাটা শুরু করি মাত্র ৪০০ টাকা দিয়ে। অথচ গত ছয় বছরে এত ভালো বিক্রি হবে তা ভাবিনি। এ পর্যন্ত রিপিট কাস্টমার পেয়েছি হাজারের বেশি। তবে বিজনেসটা শুরু করেছিলাম একটা স্বপ্ন থেকে শখের বশেই। প্রথম যেদিন নিজহাতে বানানো খাবার কাস্টমারের হাতে পৌঁছে দিই, সেই অনুভূতিটা ছিল অসাধারণ। কাস্টমারের কাছ থেকে পাওয়া ফিডব্যাক ছিল কাজের প্রতি অনেক বড় অনুপ্রেরণা। নিজহাতে রান্না করে প্রথম উপার্জন ছিল সামান্য। সেই সামান্য উপার্জন আমার কাছে অনেক বড় পাওয়া। আগে বাবার পরিচয়ে বড় হয়েছি, এখন নিজের পরিচয়ে সমাজে আরো বড় হতে চাই। হোমমেড খাবারের জগতে একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে আরো বড় বড় স্বীকৃতি অর্জন করতে চাই’।
অন্যরকম কিছু করার ইচ্ছে নিয়েই ছোট থেকে বেড়ে ওঠা এই নারী উদ্যোক্তা আরো বলেন, অনেকের ইচ্ছাই থাকে পড়াশোনা শেষে চাকরি করবে কিন্তু আমার কখনো চাকরি করার ইচ্ছা জাগেনি। চারপাশে হাজারো মানুষের চাকরির জন্য দিনরাত পড়াশোনা এবং আর্তনাদ দেখে আরও চাকরির উপরে আগ্রহ হারিয়ে গিয়েছে। পরিবার থেকে চাকরির কথা বললেও ব্যবসা শুরুর পর আর কখনো চাকরির দিকে তাকাতে হয়নি। এছাড়া নারীদের আত্মসম্মানহীন ঘটনার কথা চিন্তা করে বাড়ির বাহিরে গিয়ে কাজ করার মানসিকতাও আমার নেই। ঘরে বসেও যে একজন নারী ভালো ইনকাম এবং সব ধরনের প্রয়োজন পূরণ করতে পারে তার উদাহরণ আমি নিজেই।
দেশের বেকার সমস্যা নিরসনে মাহমুদা ইয়াসমিন সাবিকা বলেন, ‘বেকার সমস্যা নিরসনে সরকার যথেষ্ট সুযোগ ও সব রকম সহায়তা করছে এবং অনেকগুলো সেক্টরে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। যার যে বিষয়ে ভালো লাগে, সে সেটিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষ হয়ে কাজে নেমে পড়তে পারে। তবে আজ কাজ শুরু করলাম, আগামীকাল লাভবান হবো, এমন নয়। কমপক্ষে এক বছর লেগে থাকতে হবে এবং নিজেকে একজন দক্ষ কর্মী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে।
অন্যের ওপর ভরসা করা যাবে না। নিজে চেষ্টা করলে, আমার মনে হয়, অসাধ্য বলে কোন কিছু নেই।’
• লেখক : মো. মাসুদ হোসেন